সাম্যবাদী কবিতার ব্যাখ্যা | Samyabadi kabitar bakhya

সাম্যবাদী কবিতার লাইন বাই লাইন ব্যাখ্যা


"গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্‌লিম-ক্রীশ্চান।"

কবি সাম্যের গান গাইছেন। কবির সাম্য-ভাবনার কাছে এসে মানুষে মানুষে সমস্ত বিভেদ মুছে গেছে। সেখান এসে এক হয়ে গেছে হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম, ক্রিশ্চান।

গাহি সাম্যের গান!
কে তুমি? পার্সী? জৈন? ইহুদী? সাঁওতাল, ভীল, গারো?
কন্‌ফুসিয়াস্‌? চার্বাক চেলা? ব’লে যাও, বলো আরো!
বন্ধু, যা-খুশি হও,

পাঠকের কাছে কবির প্রশ্ন, তিনি কে? কী তাঁর পরিচয়? তিনি কি পার্সী? জৈন? ইহুদী? সাঁওতাল, ভীল বা গারো? নাকি তিনি কনফুসিয়াস? নাকি চার্বাকপন্থী নাস্তিক? আর‌ও কিছু থাকলে তাও বলতে পারেন। তিনি যা খুশি হতে পারেন। 

পেটে পিঠে কাঁধে মগজে যা-খুশি পুঁথি ও কেতাব বও,
কোরান-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-ত্রিপিটক-
জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থসাহেব প’ড়ে যাও, যত সখ-

পেটে পিঠে কাঁধে বা মগজে যা খুশি ধর্মগ্রন্থ বহন করতে পারেন। যে কোনো ধর্মগ্রন্থ পড়তে পারেন, যত খুশি।

কিন্তু, কেন এ পণ্ডশ্রম? মগজে হানিছ শূল?
দোকানে কেন এ দর কষাকষি? পথে ফুটে তাজা ফুল!

কিন্তু ধর্মগ্রন্থ পাঠ করাকে কবি পণ্ডশ্রম মনে করেন। ধর্মগ্রন্থ পাঠ করা মানে মগজে শূল হানার মতোই। পথের পাশে তাজা ফুল ফুটে থাকতে দোকানে গিয়ে ফুলের জন্য দর কষাকষি করাকে বোকামি ছাড়া আর কী বলে? 

তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান,
সকল শাস্ত্র খুঁজে পাবে সখা, খুলে দেখ নিজ প্রাণ!
তোমাতে রয়েছে সকল ধর্ম, সকল যুগাবতার,
তোমার হৃদয় বিশ্ব-দেউল সকল দেবতার।
কেন খুঁজে ফের দেবতা ঠাকুর মৃত পুঁথি -কঙ্কালে?
হাসিছেন তিনি অমৃত-হিয়ার নিভৃত অন্তরালে!

কারণ: মানুষের মধ্যেই রয়েছে সকল ধর্মগ্রন্থ, চিরকালের চিরন্তন জ্ঞান। মানুষের প্রাণের মধ্যেই আছে সব শাস্ত্রের সার কথা। সব ধর্ম, সকল অবতার মানুষের মধ্যেই আছে। মানুষের হৃদয়-মন্দির‌ই সকল দেবতার পবিত্র বাসভূমি। তাই মৃত ধর্মগ্রন্থের কঙ্কালের মধ্যে দেবতাকে অন্বেষণ করার মতো মূর্খামি আর নেই। দেবতাকে ধর্মগ্রন্থে খুঁজতে গেলে স্বয়ং দেবতাই মানব-হৃদয়ের অন্তরালে থেকে মুচকি হাসেন।

বন্ধু, বলিনি ঝুট,
এইখানে এসে লুটাইয়া পড়ে সকল রাজমুকুট।

কবি মিথ্যে বলছেন না। এই হৃদয়ের কাছে এসেই রাজমুকুট মাটিতে লুটিয়ে পড়ে‌। 

এই হৃদয়‌ই সে নীলাচল, কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন,
বুদ্ধ-গয়া এ, জেরুজালেম এ, মদিনা, কাবা-ভবন,
মস্‌জিদ এই, মন্দির এই, গির্জা এই হৃদয়,
এইখানে ব’সে ঈসা মুসা পেল সত্যের পরিচয়।

এই হৃদয়‌ই পরম তীর্থ নীলাচল, ঈশ্বরের লীলাভূমি কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন। এই হৃদয়‌ই গৌতম বুদ্ধের বুদ্ধগয়া। এই হৃদয়‌ই জেরুজালেম, মদিনা। এই হৃদয়‌ই মন্দির, মসজিদ, গীর্জা, কাবা ভবন। এই হৃদয়ের মন্দিরে বসেই ইসা মুসা পরম সত্যকে লাভ করেছিলেন।

এই রণ-ভূমে বাঁশীর কিশোর গাহিলেন মহা-গীতা,
এই মাঠে হ’ল মেষের রাখাল নবীরা খোদার মিতা।

এই হৃদয়ের রণভূমিতেই বংশীধারী শ্রীকৃষ্ণ মহান গীতার বাণী উচ্চারণ করেছিলেন। এই হৃদয়ের প্রান্তরেই মেষপালক নবীরা আল্লাহতায়ালার মিত্রতা লাভ করেছিলেন।

এই হৃদয়ের ধ্যান-গুহা-মাঝে বসিয়া শাক্যমুনি
ত্যজিল রাজ্য মানবের মহা-বেদনার ডাক শুনি’।

এই হৃদয়ের ধ্যানগুহাতে বসেই শাক্যমুনি রাজ্য ত্যাগ করে মানুষের বেদনা মুক্তির তপস্যা শুরু করেছিলেন।

এই কন্দরে আরব-দুলাল শুনিতেন আহ্বান,
এইখানে বসি’ গাহিলেন তিনি কোরানের সাম-গান!

এই হৃদয়-কন্দরে বসেই আরব-দুলাল আল্লাহর আহ্বান শুনেছেন, এইখানে বসেই তিনি কোরানের বাণী উচ্চারণ করেছেন।

মিথ্যা শুনিনি ভাই,
এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই।

কবি মিথ্যা শোনেননি। সত্যিই এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির কাবা নেই।

সাম্যবাদী কবিতার মূল বক্তব্য

কাজী নজরুল ইসলামের লেখা সাম্যবাদী কবিতায় কবি এক বিপন্ন সময়ে দাঁড়িয়ে মানুষের কাছে মানবতার এক নতুন বার্তা পৌঁছে দিতে চেয়েছেন। ধর্মীয় বিভেদের ফলে ছিন্নভিন্ন সমাজের কানে তিনি এক নতুন মন্ত্র তুলে দিতে চেয়েছেন। নানা ধর্ম, নানা রীতিনীতি, নানা মতের ঊর্ধে উঠে কবি মানব-হৃদয়ের জয়গান গেয়েছেন। কবির চেতনায় মানুষের হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির, মসজিদ, গির্জা নেই। যুগে যুগে যত মহামানব এসেছেন, যত ধর্মগ্রন্থ রচিত হয়েছে, সে সব‌ই মানব-হৃদয়ের‌ই ফসল। যে ধর্মগ্রন্থ নিয়ে আজ মানুষে মানুষে হানাহানি, সেই ধর্মগ্রন্থের সার কথা আসলে মানব হৃদয়ের‌ই চিরন্তন বাণী। তাই এ যেন পথের পাশে তাজা ফুল ফুটে থাকতে থাকতে দোকানে গিয়ে ফুলের জন্য দর কষাকষি করার সামিল। তাই কবির চোখে এই প্রচেষ্টা আসলে পণ্ডশ্রম। শেষ পর্যন্ত সবাইকে এই হৃদয়ের কাছেই আশ্রয় নিতে হবে। সকল রাজমুকুট এই হৃদয়ের কাছেই পরাভূত হয়। সকল ধর্মের সার কথা এই মানব হৃদয়েই ধরা আছে। তাই বাইরের যে বিভেদ, তা এক বিরাট ভ্রান্তি। আসলে মানুষে মানুষে কোনো ভেদ নেই। এক মানব হৃদয়ের বন্ধনে আবদ্ধ আছে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ। এক সূত্রে বাঁধা আছে প্রতিটি ধর্ম, প্রতিটি ধর্মগ্রন্থ আর ধর্মস্থান।



Comments

Post a Comment

Popular Posts