অভিষেক কবিতার ব্যাখ্যা ও প্রশ্নোত্তর

অভিষেক কবিতার প্রশ্নোত্তর ও আলোচনা


কবি: মাইকেল মধুসূদন দত্ত
মূল গ্রন্থ: মেঘনাদবধ কাব্য

মাইকেল মধুসূদন দত্তের লেখা 'মেঘনাদবধকাব্য' থেকে গৃহীত হয়েছে দশম শ্রেণির পাঠ্য 'অভিষেক' নামক কাব্যাংশটি। এই অংশে বীরবাহুর মৃত্যুর পর ইন্দ্রজিতের সেনাপতি পদে অভিষেকের বর্ণনা রয়েছে।

অভিষেক

মাইকেল মধুসূদন দত্ত 


কনক-আসন ত্যজি, বীরেন্দ্রকেশরী
ইন্দ্রজিৎ, প্রণমিয়া ধাত্রীর চরণে,
কহিলা,— “কি হেতু, মাতঃ, গতি তব আজি
এ ভবনে? কহ দাসে লঙ্কার কুশল।”

শিরঃ চুম্বি, ছদ্মবেশী অম্বুরাশি-সুতা
উত্তরিলা;— “হায়! পুত্র, কি আর কহিব
কনক-লঙ্কার দশা! ঘোরতর রণে,
হত প্রিয় ভাই তব বীরবাহু বলী!
তার শোকে মহাশোকী রাক্ষসাধিপতি,
সসৈন্যে সাজেন আজি যুঝিতে আপনি।”

জিজ্ঞাসিলা মহাবাহু বিস্ময় মানিয়া;—
“কি কহিলা, ভগবতি? কে বধিল কবে
প্রিয়ানুজে? নিশা-রণে সংহারিনু আমি
রঘুবরে; খণ্ড খণ্ড করিয়া কাটিনু
বরষি প্রচণ্ড শর বৈরিদলে; তবে
এ বারতা, এ অদ্ভুত বারতা, জননি,
কোথায় পাইলে তুমি, শীঘ্র কহ দাসে।”

রত্নাকর রত্নোত্তমা ইন্দিরা সুন্দরী
উত্তরিলা;— “হায়! পুত্র, মায়াবী মানব
সীতাপতি; তব শরে মরিয়া বাঁচিল।
যাও তুমি ত্বরা করি; রক্ষ রক্ষঃকুল-
মান, এ কালসমরে, রক্ষঃ-চূড়ামণি!”

ছিঁড়িলা কুসুমদাম রোষে মহাবলী
মেঘনাদ; ফেলাইলা কনক-বলয়
দূরে; পদ-তলে পড়ি শোভিল কুণ্ডল,
যথা অশোকের ফুল অশোকের তলে
আভাময়! “ধিক্ মোরে” কহিলা গম্ভীরে
কুমার, “হা ধিক্ মোরে! বৈরিদল বেড়ে
স্বর্ণলঙ্কা, হেথা আমি বামাদল মাঝে?
এই কি সাজে আমারে, দশাননাত্মজ
আমি ইন্দ্রজিৎ, আন রথ ত্বরা করি;
ঘুচাব এ অপবাদ, বধি রিপুকুলে।”

সাজিলা রথীন্দ্রর্ষভ বীর-আভরণে
হৈমবতীসুত যথা নাশিতে তারকে
মহাসুর; কিম্বা যথা বৃহন্নলারূপী
কিরীটি, বিরাটপুত্র সহ, উদ্ধারিতে
গোধন, সাজিলা শূর, শমীবৃক্ষমূলে।
মেঘবর্ণ রথ; চক্র বিজলীর ছটা;
ধ্বজ ইন্দ্রচাপরূপী; তুরঙ্গম বেগে
আশুগতি। রথে চড়ে বীর-চূড়ামণি
বীরদর্পে, হেন কালে প্রমীলা সুন্দরী,
ধরি পতি-কর-যুগ (হায় রে, যেমতি
হেমলতা আলিঙ্গয়ে তরু-কুলেশ্বরে)
কহিলা কাঁদিয়া ধনী; “কোথা প্রাণসখে,
রাখি এ দাসীরে, কহ, চলিলা আপনি?
কেমনে ধরিবে প্রাণ তোমার বিরহে
এ অভাগী? হায়, নাথ, গহন কাননে,
ব্রততী বাঁধিলে সাধে করি-পদ, যদি
তার রঙ্গরসে মনঃ না দিয়া, মাতঙ্গ
যায় চলি, তবু তারে রাখে পদাশ্রমে
যূথনাথ। তবে কেন তুমি, গুণনিধি,
ত্যজ কিঙ্করীরে আজি?” হাসি উত্তরিলা
মেঘনাদ, “ইন্দ্রজিতে জিতি তুমি, সতি,
বেঁধেছ যে দৃঢ় বাঁধে, কে পারে খুলিতে
সে বাঁধে? ত্বরায় আমি আসিব ফিরিয়া
কল্যাণি, সমরে নাশি তোমার কল্যাণে
রাঘবে। বিদায় এবে দেহ, বিধুমুখি।”

উঠিলা পবন-পথে, ঘোরতর রবে,
রথবর, হৈমপাখা বিস্তারিয়া যেন
উড়িলা মৈনাক-শৈল, অম্বর উজলি!
শিঞ্জিনী আকর্ষি রোষে, টঙ্কারিলা ধনুঃ
বীরেন্দ্র, পক্ষীন্দ্র যথা নাদে মেঘ মাঝে
ভৈরবে। কাঁপিলা লঙ্কা, কাঁপিলা জলধি!

সাজিছে রাবণরাজা, বীরমদে মাতি;—
বাজিছে রণ-বাজনা; গরজিছে গজ;
হেষে অশ্ব; হুঙ্কারিছে পদাতিক, রথী;
উড়িছে কৌশিক-ধ্বজ; উঠিছে আকাশে
কাঞ্চন-কঞ্চুক-বিভা। হেন কালে তথা
দ্রুতগতি উতরিলা মেঘনাদ রথী।

নাদিলা কর্বূরদল হেরি বীরবরে
মহাগর্বে। নমি পুত্র পিতার চরণে,
করজোড়ে কহিলা;— “হে রক্ষঃ-কুল-পতি,
শুনেছি, মরিয়া নাকি বাঁচিয়াছে পুনঃ
রাঘব? এ মায়া, পিতঃ, বুঝিতে না পারি!
কিন্তু অনুমতি দেহ; সমূলে নির্মূল
করিব পামরে আজি! ঘোর শরানলে
করি ভস্ম, বায়ু-অস্ত্রে উড়াইব তারে;
নতুবা বাঁধিয়া আনি দিব রাজপদে।”

আলিঙ্গি কুমারে, চুম্বি শিরঃ, মৃদুস্বরে
উত্তর করিলা তবে স্বর্ণ-লঙ্কাপতি;
“রাক্ষস-কুল-শেখর তুমি, বৎস; তুমি
রাক্ষস-কুল-ভরসা। এ কাল সমরে,
নাহি চাহে প্রাণ মম পাঠাইতে তোমা
বারংবার। হায়, বিধি বাম মম প্রতি।
কে কবে শুনেছে পুত্র, ভাসে শিলা জলে,
কে কবে শুনেছে, লোক মরি পুনঃ বাঁচে?”

উত্তরিলা বীরদর্পে অসুরারি-রিপু;—
“কি ছার সে নর, তারে ডরাও আপনি,
রাজেন্দ্র? থাকিতে দাস, যদি যাও রণে
তুমি, এ কলঙ্ক, পিতঃ, ঘুষিবে জগতে।
হাসিবে মেঘবাহন; রুষিবেন দেব
অগ্নি। দুই বার আমি হারানু রাঘবে;
আর এক বার পিতঃ, দেহ আজ্ঞা মোরে;
দেখিব এবার বীর বাঁচে কি ঔষধে!”

কহিলা রাক্ষসপতি;— “কুম্ভকর্ণ বলী
ভাই মম,— তায় আমি জাগানু অকালে
ভয়ে; হায়, দেহ তার, দেখ, সিন্ধু-তীরে
ভূপতিত, গিরিশৃঙ্গ কিম্বা তরু যথা
বজ্রাঘাতে! তবে যদি একান্ত সমরে
ইচ্ছা তব, বৎস, আগে পূজ ইষ্টদেবে,—
নিকুম্ভিলা যজ্ঞ সাঙ্গ কর, বীরমণি!
সেনাপতি-পদে আমি বরিণু তোমারে।
দেখ, অস্তাচলগামী দিননাথ এবে;
প্রভাতে যুঝিও, বৎস, রাঘবের সাথে।”

এতেক কহিয়া রাজা, যথাবিধি লয়ে
গঙ্গোদক, অভিষেক করিলা কুমারে।

অভিষেক' কবিতার সরল অর্থ


সোনার আসন ত্যাগ করে বীরসিংহ ইন্দ্রজিৎ ধাত্রী মায়ের চরণে প্রণাম করে বললেন, "মা, কী কারণে আজ তোমার এই ভবনে আগমন? তোমার এই দাসকে লঙ্কাপুরীর কুশল সংবাদ বলো।"

মস্তকে চুম্বন করে ছদ্মবেশী লক্ষ্মী(অম্বুরাশি তথা সমুদ্রের কন্যা) উত্তর দিলেন, "হায় পুত্র, কী আর বলব স্বর্ণ লঙ্কার দশা! ঘোর যুদ্ধে তোমার প্রিয় ভাই বলবান বীরবাহু নিহত। তার শোকে রাক্ষস রাজা মহাশোক-গ্রস্ত এবং নিজেই যুদ্ধ করার জন্য সসৈন্যে সজ্জিত হচ্ছেন।"

মহাবাহু(ইন্দ্রজিৎ) বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, "কী বললেন, ভগবতী? প্রিয় ভাইকে কে কবে বধ করল? রাত্রিকালীন যুদ্ধে আমি রঘুবরকে বধ করলাম। প্রচণ্ড শর বর্ষণ করে শত্রুদলকে খণ্ড খণ্ড করে কাটলাম। তবে এ বার্তা, এ অদ্ভুত বার্তা তুমি কোথায় পেলে, জননী? শিঘ্রই এই দাসকে তা বলো।"

রত্নাকর তথা সমুদ্রের শ্রেষ্ঠ রত্ন ইন্দিরা সুন্দরী (লক্ষ্মী) উত্তর দিলেন, "হায়! পুত্র, সীতাপতি (রাম) মায়াবী মানুষ; তোমার শরে মরেও বেঁচে উঠলো। তুমি তাড়াতাড়ি যাও। এই কাল সমরে রাক্ষসকুলের মান মর্যাদা তুমি রক্ষা করো, হে রাক্ষস-চূড়ামণি‌।"

মহবলী মেঘনাদ ক্রোধে সমস্ত ফুল ছিঁড়ে ফেললেন। সোনার বালা দূরে ফেলে দিলেন। অশোক বৃক্ষের নিচে অশোকের ফুল যেমন আভাময় হয়ে ওঠে, তেমনি তাঁর পায়ের কাছে শোভা পেতে লাগল কুণ্ডল (দুল)। গম্ভীর স্বরে কুমার (ইন্দ্রজিৎ) বললেন, "ধিক্ আমাকে! হায়, ধিক্ আমাকে! শত্রুদল লঙ্কাকে ঘিরে রেখেছে, আর আমি এখানে স্ত্রীলোকদের মাঝে রয়েছি?এই কি আমাকে মানায়? আমি দশাননের পুত্র ইন্দ্রজিৎ। তাড়াতাড়ি রথ নিয়ে এসো। শত্রুকুলকে বধ করে আমি এ অপবাদ দূর করবো।"

রথীন্দ্রর্ষভ (রথীন্দ্র+ঋষভ = মহারথী) ইন্দ্রজিৎ বীরের পোশাকে সজ্জিত হলেন, যেমন ভাবে হৈমবতীসূত (কার্ত্তিক) সজ্জিত হয়েছিলেন মহাসুর তারককে বধ করার জন্য অথবা বৃহন্নলারূপী অর্জুন বিরাটপুত্রকে(উত্তর) সঙ্গে নিয়ে গোধন উদ্ধার করার জন্য শমীবৃক্ষের গোড়ায় সজ্জিত হয়েছিলেন। মেঘবর্ণের রথ, চাকায় বিদ্যুতের ছটা, পতাকা রামধনু রঙের, ঘোড়াগুলি অতি দ্রুতগতিসম্পন্ন। বীরচূড়ামণি রথে চড়লেন বীরদর্পে। এমন সময় প্রমীলা সুন্দরী (ইন্দ্রজিৎ-পত্নী) স্বামীর হাত দুটি ধরে (যে ভাবে স্বর্ণলতা বৃক্ষকে জড়িয়ে ধরে) কেঁদে বললেন, "প্রাণসখা, এই দাসীকে রেখে আপনি কোথায় চললেন বলুন? তোমার বিরহে এই অভাগী কেমন করে প্রাণ ধারণ করবে? হায়, প্রভু, গহন বনে লতা যখন সাধ করে হাতির পায়ে জড়িয়ে ধরে তখন তার এই রঙ্গরসে মন না দিয়ে হাতি যদি চলেও যায়, তবুও হাতি তাকে নিজের পায়েই রাখে(অর্থাৎ, ফেলে দেয় না)। তবে তুমি, হে গুণনিধি(গুণবান), কেন দাসীকে ত্যাগ করছ আজ?" মেঘনাদ তখন হেসে উত্তর দিলেন,"ইন্দ্রজিৎকে জয় করে তুমি যে দৃঢ় বন্ধনে বেঁধেছো, সে বন্ধন কে খুলতে পারে, সতী? আমি তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো, তোমার কল্যাণে রামকে বধ করে। এখন বিদায় দাও চন্দ্রমুখী।"

ঘোর রবে রথ উঠে গেলো আকাশে, যেন সোনার পাখা বিস্তার করে আকাশকে উজ্জ্বল করে দিয়ে মৈনাক পর্বত উড়ে গেলো। ধনুকের ছিলা আকর্ষণ করে ক্রোধে ধনুকে টংকার দিলেন বীরশ্রেষ্ঠ ইন্দ্রজিৎ। যেন পক্ষীরাজ (গরুড়) ভৈরব রবে ডেকে উঠলেন আকাশে। লঙ্কাপুরী কেঁপে উঠলো, সমুদ্র কেঁপে উঠলো।

রাবণ রাজা বীরমদে মত্ত হয়ে সজ্জিত হচ্ছেন। যুদ্ধের বাজনা বাজছে; হাতি গর্জন করছে, অশ্ব হ্রেষাধ্বনি করছে; পদাতিক ও রথীরা হুঙ্কার দিচ্ছে; রেশমী পতাকা উড়ছে; আকাশে উঠছে সোনার বর্মের বিভা। এমন সময় দ্রুতগতিতে নেমে এলেন বীর মেঘনাদ। 

রাক্ষসদল মহাবীরকে দেখে গর্জন করে উঠলো মহাগর্বে। পিতার চরণে প্রণাম করে পুত্র জোড়হাতে বললেন,"হে রাক্ষসকুলপতি, শুনেছি রাম নাকি মরেও আবার বেঁচে উঠেছে? এ মায়া, পিতা, বুঝতে পারছি না! কিন্তু অনুমতি দিন, পামরকে আজ সমূলে নির্মূল করব। ঘোর শরের আগুনে ভস্ম করে বায়ু অস্ত্র দিয়ে তা উড়িয়ে দেব, অথবা বেঁধে আপনার পায়ে এনে ফেলবো।"

কুমারকে আলিঙ্গন করে, মাথায় চুম্বন করে, স্বর্ণলঙ্কাপতি বললেন,"বৎস, তুমি রাক্ষস কুলের শিখর, রাক্ষস কুলের ভরসা। এ কাল যুদ্ধে তোমাকে বার বার পাঠাতে আমার প্রাণ চায় না। হায়, বিধাতা আমার প্রতি বিরূপ। কে কবে শুনেছে পুত্র পাথর জলে ভাসে? কে কবে শুনেছে, মানুষ মরেও আবার বেঁচে ওঠে?"

অসুরারি-রিপু (অর্থাৎ ইন্দ্রের শত্রু, ইন্দ্রজিৎ) উত্তর দিলেন, "কী ছার সে মানুষ, যে তাকে আপনি ভয় পান, রাজেন্দ্র? আপনার এই দাস থাকতে আপনি যুদ্ধে গেলে এ কলঙ্ক জগতে ঘোষিত হবে, পিতা। ইন্দ্র হাসবেন, অগ্নিদেব রুষ্ট হবেন। দুবার আমি রামচন্দ্রকে হারালাম। আর একবার পিতা আমাকে আদেশ দিন, দেখব এবার বীর কী ওষুধে বাঁচে।"

রাক্ষসপতি রাবণ বললেন, "কুম্ভকর্ণ, আমার বলবান ভাই, তাকে আমি অকালে জাগালাম ভয়ে। হায়, দেখ তার দেহ সমুদ্রতীরে পড়ে আছে, যেমন বজ্রাঘাতে গিরিশৃঙ্গ অথবা বৃক্ষ পড়ে যায়। তবে যদি তোমার একান্ত যুদ্ধে ইচ্ছা থাকে, তবে বৎস, আগে ইষ্টদেবের পূজা করো--- নিকুম্ভিলা যজ্ঞ সাঙ্গ করে, বীরমণি। সেনাপতি পদে আমি তোমাকে বরণ করলাম। দেখ, সূর্য এখন অস্তাচলগামী, পুত্র, তুমি রামচন্দ্রের সাথে প্রভাতে যুদ্ধ করবে।" 

এই বলে রাজা যথাবিধি গঙ্গাজল নিয়ে কুমারকে অভিষিক্ত করলেন।

অভিষেক কবিতায় ইন্দ্রজিৎ চরিত্রের পরিচয় দাও


মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত মেঘনাদবধ কাব্যের কেন্দ্রীয় চরিত্র রাবণ-পুত্র ইন্দ্রজিৎ বা মেঘনাদ। মেঘনাদবধ কাব্য থেকে গৃহীত 'অভিষেক' কাব্যাংশের স্বল্প পরিসরেই ইন্দ্রজিৎ চরিত্রের মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলি সুন্দর ভাবে ধরা পড়েছে। নিচে পাঠ্যাংশ অনুসরণে ইন্দ্রজিৎ চরিত্রের সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো।

বীরত্ব ও সাহস

ইন্দ্রজিৎ চরিত্রের সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে একটি হলো তাঁর বীরত্ব ও সাহস। মহাবীর ইন্দ্রজিৎ রামচন্দ্রকে দু বার পরাজিত করেন। ভাইয়ের মৃত্যুর কথা শুনে তিনি পুনরায় যুদ্ধে যেতে উদ্যত হয়েছেন এবং তিনি প্রতিজ্ঞা করেন এরপর রামচন্দ্রকে তিনি ভস্মীভূত করবেন অথবা বন্দি করে আনবেন।

দেশপ্রেম

অকৃত্রিম দেশপ্রেম মেঘনাদের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাই প্রভাষার ছদ্মবেশে লক্ষ্মীদেবীকে প্রথম দেখেই তিনি মাতৃভূমির কুশল জানতে চেয়েছেন, "কহ দাসে লঙ্কার কুশল।" আত্মীয় পরিজনের চেয়েও জন্মভূমি তাঁর কাছে বড়ো।

কর্তব্যবোধ

ইন্দ্রজিতের কর্তব্যবোধ অতুলনীয়। তাই তিনি নিজে বর্তমান থাকতে পিতাকে যুদ্ধে যেতে না দিয়ে নিজের কাঁধে দায়িত্ব তুলে নিয়েছেন। দেশের দুঃসময়ে যুদ্ধক্ষেত্রে না গিয়ে বিলাসিতায় মগ্ন থাকার কারণে তিনি আত্মগ্লানিতে নিজেকে ধিক্কার দিয়েছেন। এ থেকেও তাঁর কর্তব্যবোধের পরিচয় মেলে।

আত্মমর্যাদা

বীরোচিত আত্মমর্যাদা মেঘনাদ চরিত্রের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। নিজের বীরত্বের মর্যাদায় যাতে কালি না পড়ে সে বিষয়ে তিনি সতর্ক। 

মানবিক গুণ

মহাবীর যোদ্ধা হলেও মানবিক গুণেও ইন্দ্রজিৎ অদ্বিতীয়। গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধা, বিনয়, পিতৃভক্তি ও পত্নীপ্রেমের মতো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ইন্দ্রজিৎ চরিত্রে ভিন্নতর মাত্রা যোগ করেছে।

"এ কাল সমরে নাহি চাহে প্রাণ মম পাঠাইতে তোমা বারংবার।" - বক্তা কে? উদ্ধৃত অংশে বক্তার কোন মানসিকতার প্রকাশ ঘটেছে আলোচনা করো।

মাইকেল মধুসূদন দত্তের লেখা 'মেঘনাদবধকাব্য' থেকে গৃহীত 'অভিষেক' শীর্ষক কাব্যাংশে লঙ্কেশ্বর রাবণ তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র ইন্দ্রজিৎকে উদ্দেশ্য করে উদ্ধৃত কথাগুলি বলেছেন।

ইন্দ্রজিৎ যখন ভ্রাতা বীরবাহুর হত্যার প্রতিশোধ নিতে রামচন্দ্রের বিরুদ্ধে আর একবার যুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন, তখন রাবণ তাঁকে এই কথাগুলি বলেন। রাবণের এই কথাগুলি থেকে তাঁর আশঙ্কাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। রামচন্দ্রের সঙ্গে যুদ্ধে মহাবিক্রমশালী রাবণের বাহিনীর একের পর এক বীর যোদ্ধা মৃত্যু বরণ করছেন, এমনকি মহাবীর কুম্ভকর্ণ‌ও বাদ যাননি। এমতাবস্থায় রাবণ বুঝতে পারেন এই যুদ্ধ তাঁর পক্ষে অতি কঠিন এক পরীক্ষা। তিনি জানেন তাঁর পুত্র ইন্দ্রজিৎ মহাবীর; তাঁকে পরাস্ত করা রামচন্দ্রের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। তা সত্ত্বেও তিনি তাঁকে যুদ্ধে যেতে দিতে চান না, কারণ তিনি মনে করেন নিয়তি তাঁর বিপক্ষে। তা ন‌ইলে সমুদ্রের উপর পাথর ভাসে না, মৃত মানুষ পুনরায় বেঁচে ওঠে না। অথচ তাঁর বিপক্ষে ও রামচন্দ্রের পক্ষে এইসব অসম্ভব ঘটনাই ঘটেছে। 

পরিশেষে বলা যায় রাবণের এই উক্তি এক চিরন্তন পিতৃহৃদয়ের আকুতি। যত‌ই তিনি মহাপরাক্রমশালী রাজা হোন, শেষ পর্যন্ত তিনিও এক পিতা। তাঁর একমাত্র উত্তরাধিকারী হিসেবে অবশিষ্ট আছেন পুত্র ইন্দ্রজিৎ। তাঁকে যুদ্ধে পাঠাতে তিনি আশঙ্কিত হবেন, এটাই স্বাভাবিক।

অভিষেক কাব্যাংশে রাবণ চরিত্রের পরিচয় দাও

 মাইকেল মধুসূদন দত্তের লেখা 'মেঘনাদবধ' কাব্য থেকে গৃহীত 'অভিষেক' কাব্যাংশে রাবণ চরিত্রের একটি ভিন্নধর্মী রূপ ফুটে উঠেছে। 

এই কাব্যাংশে লঙ্কার রাজা রাবণের স্নেহময় পিতৃ হৃদয়ের পরিচয় পাওয়া যায় এখানে তিনি রাজা নন, একজন পিতা হিসেবে প্রতিভাত হয়েছেন। ভ্রাতা কুম্ভকর্ণ ও পুত্র বীরবাহুর মৃত্যুতে তিনি শংকিত ও বিচলিত। তাই তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র ইন্দ্রজিৎকে যুদ্ধে পাঠাতে চাইছেন না। এই কাব্যাংশে লঙ্কার রাজা রাবণ একজন ভাগ্যবিড়ম্বিত পুরুষ। তিনি বলেছেন "হায়, বিধি বাম মম প্রতি।" এই কারণে তিনি ইন্দ্রজিৎকে নিয়ে আশঙ্কিত। বীরবাহুর মৃত্যুতে তিনি নিজেই যুদ্ধে যাওয়ার জন্য সজ্জিত হচ্ছেন। তিনি অনুভব করেছেন যে, রামচন্দ্রের সাথে এই যুদ্ধ তার পক্ষে এক কাল যুদ্ধ। এইভাবে অভিষেক কাব্যাংশে রাবণ চরিত্রের স্নেহশীল, ভাগ্যবিড়ম্বিত ও দ্বিধাগ্রস্ত রূপটি ফুটে উঠেছে। 

"এ কলঙ্ক, পিতঃ, ঘুষিবে জগতে!" -- কোন ব্যাপারকে কলঙ্ক বলা হয়েছে? এই উক্তিতে বক্তার চরিত্রের কোন বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে?


বীরবাহুর মৃত্যুর পর শোকে উন্মাদ হয়ে রাজা রাবণ যুদ্ধে যাওয়ার জন্য সজ্জিত হচ্ছেন। এমন সময় রাবণের জ্যেষ্ঠ পুত্র ইন্দ্রজিৎ এসে রাবণের পরিবর্তে নিজে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করেন। কারণ, তিনি মনে করেন পুত্র জীবিত থাকতে পিতা যুদ্ধে গেলে পুত্রকে সবাই কাপুরুষ ও ভীরু মনে করবে। বীর ইন্দ্রজিৎ একেই কলঙ্ক বলেছেন।

ইন্দ্রজিতের এই কথা থেকে তাঁর চরিত্র সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়। তাঁর এই বক্তব্য থেকে জানা যায়, তিনি একজন প্রকৃত যোদ্ধা ও সাহসী বীর। প্রবল প্রতিপক্ষ রামচন্দ্রের বিরুদ্ধে নিজেই যুদ্ধে যেতে চেয়েছেন। এ ছাড়া, ইন্দ্রজিতের কর্তব্যপরায়ণতা এবং আত্মমর্যাদা এই উক্তিতে ধরা পড়েছে।

"নিকুম্ভিলা যজ্ঞ সাঙ্গ কর বীরমণি।" -- বক্তার এমন বক্তব্যের কারণ কী? এই উক্তিতে বক্তার কোন মনোভাব ফুটে উঠেছে?

উদ্ধৃত অংশটি মাইকেল মধুসূদন দত্তের লেখা 'মেঘনাদবধ' কাব্য থেকে সংকলিত 'অভিষেক' কাব্যাংশ থেকে নেওয়া হয়েছে। 

রামচন্দ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাঠানোর আগে পুত্র ইন্দ্রজিৎ-কে এই কথা বলেছেন লঙ্কার রাজা রাবণ। রাবণ জানেন রামচন্দ্র একজন প্রবল শত্রু। তাঁর হাতে কুম্ভকর্ণ ও বীরবাহুর মত বীরেরা নিহত হয়েছেন। দেবতার বরে, নিকুম্ভিলা যজ্ঞ সাঙ্গ করার পর যুদ্ধে গেলে ইন্দ্রজিৎ অপরাজেয় হয়ে যান। তাই রাবণ ইন্দ্রজিতের নিরাপত্তার জন্য তাঁকে এই নির্দেশ দিয়েছেন।

রাবণের এই উক্তির মধ্য দিয়ে একজন স্নেহশীল  পিতাকে দেখতে পাওয়া যায়। তিনি নিজের পুত্রের নিরাপত্তার ব্যাপারে চিন্তিত ও আশঙ্কিত। তাই তিনি চান যুদ্ধে যাওয়ার আগে তাঁর পুত্র যেন নিকুম্ভিলা যজ্ঞ সাঙ্গ ক'রে নিজেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ করে নেয়। 



আর‌ও পড়ো













Comments

Popular Posts