ঝর্ণা কবিতার ব্যাখ্যা | Jharna kabitar bakhya

ঝর্ণা কবিতার ব্যাখ্যা, শব্দার্থ ও প্রশ্নোত্তর

ঝর্ণা
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
ঝর্ণা কবিতা


সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা 'ঝর্ণা' কবিতাটি বিভিন্ন বোর্ডের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সিলেবাসে পাঠ্য হিসেবে আছে। ছাত্রছাত্রীদের সুবিধার জন্য কবিতাটির সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা, শব্দার্থ ও প্রশ্নোত্তর এখানে আলোচনা করা হলো।

"ঝর্ণা! ঝর্ণা! সুন্দরী ঝর্ণা! তরলিত চন্দ্রিকা! চন্দন-বর্ণা!"

কবিতার প্রথমেই কবি ঝর্ণাকে 'সুন্দরী' বলার মধ্যে দিয়ে স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, এই কবিতায় তিনি ঝর্ণাকে এক সুন্দরী নারী রূপে কল্পনা করেছেন। ঝর্ণার জল দেখে কবির মনে হয়েছে তা যেন তরলিত চন্দ্রালোক। অর্থাৎ চাঁদের আলো বুঝি বা তরল হয়ে ঝরে পড়ছে। ঝর্ণার দেহের রঙ চন্দনের মতো উজ্জ্বল।

   
 "অঞ্চল সিঞ্চিত গৈরিকে স্বর্ণে, 
     গিরি-মল্লিকা দোলে কুন্তলে কর্ণে," 

ঝর্ণার আঁচলে গৈরিক আর সোনালী রঙের ছাপ। সূর্যের আলো ঝর্ণার আঁচলকে গৈরিক আর স্বর্ণাভ রঙে রাঙিয়ে তোলে। পাহাড়ি মল্লিকা ফুল ঝর্ণার চুলে আর কানে দুলছে।

"তনু ভরি' যৌবন, তাপসী অপর্ণা! 
            ঝর্ণা!"
ঝর্ণা যেন তপস্বিনী অপর্ণা, তার প্রতি অঙ্গে যৌবনের চিহ্ন।

"পাষাণের স্নেহধারা! তুষারের বিন্দু! 
ডাকে তোরে চিত-লোল উতরোল সিন্ধু।"

পাষাণ, অর্থাৎ পর্বতের বুক চিরে বেরিয়ে আসে বলে ঝর্ণাকে কবি পাষাণের স্নেহধারা বলেছেন। তুষার বিন্দুর মতোই শীতল সেই স্নেহ। চঞ্চলচিত্ত উত্তাল সমুদ্র ঝর্ণাকে নিজের কাছে ডাকছে।

     
"মেঘ হানে জুঁইফুলী বৃষ্টি ও-অঙ্গে, 
     চুমা-চুমকীর হারে চাঁদ ঘেরে রঙ্গে, 
ধূলা-ভরা দ্যায় ধরা তোর লাগি ধর্ণা! 
             ঝর্ণা!"

মেঘ থেকে বৃষ্টির ধারা যখন ঝর্ণার দেহে ঝরে পড়ে, তখন মনে হয় মেঘ যেন ঝর্ণার গায়ে জুঁইফুল ছুঁড়ে মারছে। চাঁদ‌ও পিছিয়ে থাকে না, সেও চুমকির হার দিয়ে ঝর্ণাকে অপরূপ সৌন্দর্য দান করে। ধূলাভরা পৃথিবী ঝর্ণার জন্য ধর্না দেয়। 


"এস তৃষ্ণার দেশে এস কলহাস্যে - 
গিরি-দরী-বিহারিনী হরিণীর লাস্যে, 
     ধূসরের ঊষরের কর তুমি অন্ত, 
     শ্যামলিয়া ও পরশে কর গো শ্রীমন্ত; 
ভরা ঘট এস নিয়ে ভরসায় ভর্ণা; 
             ঝর্ণা!"

ঝর্ণাকে কবি তৃষ্ণার দেশে আহ্বান জানিয়েছেন। কবি ঝর্ণাকে বলেছেন সে যেন ধূসর আর ঊষরের সমাপ্তি ঘটায়। তার শ্যামল পরশে ঊষর ভূমি সৌন্দর্যময় হয়ে উঠুক। মঙ্গলময় পূর্ণ কলস নিয়ে আসুক ঝর্ণা। 

"শৈলের পৈঠায় এস তনুগাত্রী! 
পাহাড়ের বুক-চেরা এস প্রেমদাত্রী!" 

পাহাড়ের সিঁড়ি বেয়ে ক্ষীণকায়া ঝর্ণাকে কবি নেমে আসতে বলেছেন। পাহাড়ের বুক চিরে বেরিয়ে আসা ঝর্ণাকে কবি প্রেমদাত্রী বলেও সম্বোধন করেছেন।

     
"পান্নার অঞ্জলি দিতে দিতে আয় গো, 
     হরিচরণ-চ্যুতা গঙ্গার প্রায় গো, 
স্বর্গের সুধা আনো মর্ত্যে সুপর্ণা! 
             ঝর্ণা!"

ঝর্ণা যখন পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসে, তখন কবির মনে হয়েছে সে যেন পান্নার অঞ্জলি দিতে দিতে নামছে। শিবের চরণ-চ্যুতা গঙ্গার সঙ্গে ঝর্ণার সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন কবি। গঙ্গার মতো ঝর্ণাও স্বর্গের সুধা মর্ত্যে নিয়ে আসছে।

"মঞ্জুল ও-হাসির বেলোয়ারি আওয়াজে 
ওলো চঞ্চলা ! তোর পথ হল ছাওয়া যে!"

ঝর্ণার পবিত্র হাসির বেলোয়ারি আওয়াজে চঞ্চলা ঝর্ণার পথ মুখরিত হয়ে উঠেছে।

 
   "মোতিয়া মোতির কুঁড়ি মূরছে ও-অলকে; 
     মেখলায়, মরি মরি, রামধনু ঝলকে 
তুমি স্বপ্নের সখী বিদ্যুৎপর্ণা!
             ঝর্ণা!"

মোতিয়া ফুলের কুঁড়ি ঝর্ণার চুলে মূর্ছা যাচ্ছে। ঝর্ণার মেখলায় রামধনুর রঙ ঝলকে উঠছে। কবি ঝর্ণাকে স্বপ্নের সখী ও বিদ্যুৎপর্ণা বলে সম্বোধন করেছেন।

ঝর্ণা কবিতার শব্দার্থ

তরলিত - তরলে পরিণত হয়েছে যা
চন্দ্রিকা - চাঁদের আলো
চন্দনবর্ণা - চন্দনের মতো রঙ যার
অঞ্চল - আঁচল
সিঞ্চিত - রঞ্জিত
গৈরিক - গেরুয়া
স্বর্ণ - সোনালী
গিরি-মল্লিকা - পাহাড়ি মল্লিকা ফুল
কুন্তল - চুল
কর্ণ - কান
তনু - দেহ
তাপসী - তপস্বিনী
চিত-লোল - চঞ্চল-চিত্ত/ যার মন চঞ্চল
উতরোল - উত্তাল
সিন্ধু - সমুদ্র
শ্রীমন্ত - সৌন্দর্য-ময়
পৈঠা - সিঁড়ি
তনুগাত্রী - ক্ষীণ দেহ যার/ ক্ষীণকায়া/কৃশাঙ্গী
সুপর্ণা - সুন্দর পর্ণ বা পাখা যার
মঞ্জুল - পবিত্র
বেলোয়ারি - কাঁচের তৈরি
মূরছে - মূর্ছিত হয়
মেখলা - এক ধরনের বস্ত্র
বিদ্যুৎপর্ণা - যার পাখার রঙ বিদ্যুতের মতো

ঝর্ণা কবিতার শব্দ ও ছন্দ

ঝর্ণা কবিতাটি শুধুমাত্র প্রকৃতি-বর্ণনার কবিতা নয়, বরং বলা যায় প্রকৃতি-বন্দনার কবিতা। প্রকৃতির অপরূপ এক সৃষ্টি ঝর্ণা। কবি ঝর্ণাকে এক অপরূপা নারী রূপে কল্পনা করেছেন ও তার সৌন্দর্যের বন্দনা করেছেন অসাধারণ ছন্দে। এই কবিতার শব্দ ও ছন্দের অসাধারণ শৌখিনতাও ঝর্ণার মতোই গতিশীল ও সুন্দর। ঝর্ণা যেমন পাহাড়ের গা বেয়ে নেচে নেচে নিচে নামে, কবিতাটির গতিশীল ছন্দ‌ও যেন সেভাবেই নেচে নেচে চলেছে।

ঝর্ণা কবিতার প্রশ্নোত্তর


১: প্রশ্ন: ঝর্ণাকে 'তরলিত চন্দ্রিকা' বলা হয়েছে কেন?


উত্তর: কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর 'ঝর্ণা' কবিতায় ঝর্ণাকে তরলিত চন্দ্রিকা বলেছেন। চন্দ্রিকা মানে চাঁদের আলো। ঝর্ণার স্বচ্ছ নির্মল জল যখন পাহাড়ের ধাপে ধাপে নিচে নেমে আসে তখন তাকে দেখে চাঁদের আলোর মতোই উজ্জ্বল লাগে। এই জল দেখে কবির মনে হয়েছে এ যেন জল নয়, চাঁদের আলোই বুঝি বা তরলে পরিণত হয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে।

২:  গিরি-মল্লিকা কী? তা কোথায় দোলে?/"গিরি-মল্লিকা দোলে কুন্তলে কর্ণে" -- ব্যাখ্যা করো।


উত্তর: গিরি-মল্লিকা হলো পাহাড়ি মল্লিকা ফুল। ঝর্ণা যখন পাহাড়ের গা বেয়ে নেচে নেচে নেমে আসে তখন পাহড়ের গায়ে ঝর্ণার দুই পাশে ফুকে থাকা পাহাড়ি মল্লিকা ফুল ঝর্ণার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। তরুণী মেয়েরা যেমন কানে ও খোঁপায় ফুল গুঁজে নিজেদের সজ্জিত করে, কবির মনে হয়েছে ঝর্ণাও হয়তো সে ভাবেই গিরি-মল্লিকার অলঙ্কারে নিজেকে সাজিয়ে তুলেছে।


আর‌ও পড়ো

Comments

  1. অসাধারণ ❤️❤️

    ReplyDelete
  2. Amar project e help kreche
    Thank you

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular Posts