আবার আসিব ফিরে কবিতার ব্যাখ্যা
আবার আসিব ফিরে: প্রতি লাইনের অর্থ ও ব্যাখ্যা
এই পোস্টে জীবনানন্দ দাশের লেখা 'আবার আসিব ফিরে' কবিতার মূল পাঠের পাশাপাশি কবিতাটির সরল অর্থ ও তাৎপর্য আলোচনা করা হলো।
কবিতার মূল পাঠ
আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে-এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয়, হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল-ছায়ায়;
হয়তো বা হাঁস হব - কিশোরীর - ঘুঙুর রহিবে লাল পায়,
সারা দিন কেটে যাবে কলমির গন্ধ ভরা জলে ভেসে ভেসে;
আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালবেসে
জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এ সবুজ করুণ ডাঙায়;
হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে।
হয়তো শুনিবে এক লক্ষ্মীপেঁচা ডাকিতেছে শিমূলের ডালে।
হয়তো খইয়ের ধান ছড়াতেছে শিশু এক উঠানের ঘাসে।
রূপসার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক সাদা ছেঁড়া পালে
ডিঙ্গা বায়; রাঙ্গা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে
দেখিবে ধবল বক; আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভীড়ে।
কবিতার সরল অর্থ
আমি আবার ফিরে আসবো, ধানসিঁড়ি নদীর তীরে, এই বাংলায়। হয়তো মানুষ হয়ে নয়, হয়তো শঙ্খচিল বা শালিকের বেশে আসবো। হয়তো ভোরের কাক হয়ে কার্তিক মাসের নবান্নের এই দেশে কুয়াশাঘেরা ভোরের আকাশে ভাসতে ভাসতে এই কাঁঠাল ছায়ায় এসে নামবো। হয়তো কোনো কিশোরীর হাঁস হবো, লাল পায়ে ঘুঙুর থাকবে, সারাদিন কলমী শাকের গন্ধে ভরা পুকুরের জলে ভেসে ভেসে কেটে যাবে। বাংলাদেশের নদী মাঠ ক্ষেতকে ভালোবেসে আমি আবার আসবো বাংলার এই সবুজ, মমতাময় ভূমিতে। হয়তো চেয়ে দেখবে সন্ধ্যার বাতাসে একটি চিল (সুদর্শন) উড়ছে। হয়তো শুনবে শিমূল গাছের ডালে একটা লক্ষ্মীপেঁচা ডাকছে। হয়তো একটি শিশু, উঠানের ঘাসে খইয়ের ধান ছড়াচ্ছে। হয়তো দেখবে রূপসা নদীর ঘোলা জলে এক কিশোর সাদা ছেঁড়া পাল খাটিয়ে ডিঙিনৌকা বাইছে। হয়তো দেখবে লাল মেঘের মধ্যে সাঁতার কেটে অন্ধকারে বাসায় ফিরছে সাদা বক। এদের ভিড়ে তুমি আমাকেই পাবে।
কবিতার ব্যাখ্যা
রূপসী বাংলা কাব্যের অন্তর্গত এই কবিতায় কবি বলেছেন মৃত্যুর পরেও তিনি এই বাংলাদেশে আবার ফিরে আসবেন, অর্থাৎ আবার জন্ম নেবেন এই বাংলাদেশে, ধানসিঁড়ি নদীর তীরে। কবি হয়তো এরপর আর মানুষ হিসেবে আসবেন না, হয়তো কোনো পাখি হবেন, যেমন শঙ্খচিল বা শালিক বা কাক হয়ে কার্তিক মাসের নবান্নের এই দেশে কুয়াশাঘেরা ভোরের বাতাসে ভেসে কাঁঠাল ছায়ায় এসে নামবেন। তিনি হয়তো কোনও কিশোরীর হাঁস হবেন। লাল পায়ে বাঁধা থাকবে ঘুঙুর। সারা দিন কলমী শাকের গন্ধ ভরা জলে ভেসে কেটে যাবে। বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে কবি আবার আসবেন জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা এই সবুজ মমতাময় ডাঙায়। হয়তো দেখা যাবে সন্ধ্যার বাতাসে একটি চিল (সুদর্শন) উড়ছে। হয়তো দেখা যাবে শিমূল গাছের ডালে বসে একটি লক্ষ্মীপেঁচা ডাকছে। হয়তো দেখা যাবে একটি শিশু উঠানের ঘাসে খইয়ের ধান ছড়াচ্ছে। হয়তো দেখা যাবে এক কিশোর রূপসা নদীর ঘোলা জলে ছেঁড়া সাদা পাল খাটিয়ে ডিঙিনৌকা বাইছে । হয়তো দেখা যাবে লাল মেঘ সাঁতার দিয়ে পার হয়ে অন্ধকারে বাসায় ফিরছে সাদা বক। এই সবার ভিড়ে কবিকেই খুঁজে পাওয়া যাবে।
কবিতার তাৎপর্য
এই কবিতায় বাংলাদেশের পল্লীপ্রকৃতির প্রতি কবির গভীর ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে। এই দেশকে কবি এতটাই ভালোবাসেন যে মৃত্যুর পরেও এর মায়া তিনি কাটাতে পারবেন না। জন্মান্তরে আবার ফিরে আসবেন এই বাংলার মাটিতে। পর জন্মে মানুষ না হলেও কবির আফশোস নেই। পাখির রূপে জন্ম নিলেও কবি সুখী হবেন। এই বাংলার প্রকৃতির মধ্যে বাঁচতে পেলেই কবি সুখী হবেন। মাতৃভূমির প্রতি এমন নিগূঢ় প্রেম সত্যিই বিরল। মাতৃভূমিকে এমন গভীর ভাবে অনুভব করার শক্তিও সব কবির নেই। এখানেই জীবনানন্দ দাশ অনন্য।
Comments
Post a Comment