বহুরূপী গল্প

বহুরূপী গল্পের প্রশ্নোত্তর

বহুরূপী গল্পে হরিদার জীবন-দর্শনের পরিচয় দাও

বহুরূপী গল্পের হরিদা একজন অদ্ভুত মানুষ। আধুনিক পৃথিবীর স্বার্থপরতা, হীনতা যেন তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। সামান্য বহুরূপীর পেশাকে অবলম্বন করে জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি, অথচ চেতনায় তিনি বহন করেন মনুষ্যত্বের সুমহান আদর্শ।

গল্পের কাহিনি অনুসরণে আমরা দেখতে পাই, বহুরূপী গল্পের হরিদা পেশার দিক থেকে একজন বহুরূপী। নানান সাজে সজ্জিত হয়ে মানুষকে আনন্দ দেওয়াই তাঁর পেশা। এতে হরিদার যে আয় হয়, তাতে তাঁর ভাতের হাঁড়িতে সবদিন চাল পড়ে না। তবু তিনি দশটা-পাঁচটার বাঁধা চাকরি করেননি। কারণ, চাকরি করলে স্বাধীনতা খর্ব হবে। আসলে হরিদা একজন খাঁটি শিল্পী। তিনি যে শিল্পের শিল্পি তা হয়তো আধুনিক নগরসভ্যতার ড্রয়িংরুমবিলাসী বাবুদের চোখে শিল্পের মর্যাদা পাবে না, কিন্তু হরিদা তার পরোয়া করেন না। একজন প্রকৃত শিল্পির মতোই তিনি নিজের শিল্পিসত্তাকে বিক্রি হয়ে যেতে দেননি। অনবদ্য দক্ষতায় তিনি সেজে ওঠেন নতুন নতুন রূপে। পরিচিত লোকেরাও ধোঁকা খেয়ে যায় তাঁর সাজের কাছে। সন্ধ্যার অন্ধকারে জগদীশবাবুর উঠোনে বিরাগীর ছদ্মবেশে হরিদা যখন হাজির হলেন, তখন হরিদার নিত্যদিনের সঙ্গিরাও তাঁকে চিনতে ব্যর্থ হয়। কেননা, হরিদা শুধু বাইরে নয়, অন্তরেও হয়ে উঠেছিলেন বিরাগী। তাই জগদীশ বাবুর দেওয়া একশো টাকা প্রণামী তিনি হেলায় প্রত্যাখ্যান করে দেন। তিনি মনে করেন ও টাকা নিলে তাঁর ঢঙ নষ্ট হয়ে যাবে। জগদীশবাবুকে তিনি শুধু মুখেই বৈরাগ্যের কথা, গূঢ় জীবনদর্শনের কথা শোনাননি, প্রকৃতপক্ষে হরিদাকে সত্যিকারের একজন বিরাগীই বলা উচিত। জীবনের প্রতি এমন নিস্পৃহ বৈরাগ্য, সত্যের প্রতি এমন একনিষ্ঠ অনুরাগ তো একজন প্রকৃত বিরাগীর‌ই থাকে। 

বহুরূপী গল্পের হরিদার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।


সুবোধ ঘোষের লেখা 'বহুরূপী' গল্পের হরিদা বাংলা গল্পসাহিত্যের একটি উজ্জ্বল চরিত্র। নিচের আলোচনায় হরিদার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হলো।

শিল্পী মন: হরিদা মানুষটি প্রকৃত অর্থেই একজন শিল্পী। তিনি তাঁর শিল্পকে ভালোবাসেন। তথাকথিত ভদ্রলোকের সমাজে হরিদার শিল্পের তত কদর হয়তো নেই, তথাপি হরিদা তাঁর বহুরূপীর ছদ্মবেশ ধারণে যে শিল্পকুশলতার পরিচয় দিয়েছেন তা প্রশংসনীয়।

বাউন্ডুলে স্বভাব: 
হরিদা মূূূলত বাউন্ডুলে ধরনের মানুষ। দশটা পাঁচটা ডিউটি করতে তাঁর প্রবল আপত্তি। তিনি দারিদ্র্য সহ্য করেছেন কিন্তু স্বাধীনতা খোয়াতে রাজি হননি। পাড়ায় পাড়ায় বহুরূপী সেজে মানুষকে বোকা বানিয়েই তিনি আনন্দ পান। নিজের প্রতিভার‌ও পরিচয় দেন।

সততা: হরিদা চরিত্রের সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য তাঁর সততা। বিশেষত নিজের কাজের প্রতি তিনি চূড়ান্ত সততার নজির রেখেছেন। জগদীশবাবু তাঁকে একশো টাকা দিতে চাইলে তিনি একজন সত্যিকারের বিরাগীর মতোই তা নিতে চাননি। 

রসবোধ: হরিদার বহুরূপী সাজগুলির মধ্যে রসবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। পুলিশ সেজে ঘুষ নেওয়া বা বাইজি সেজে শহরের রাস্তায় হেঁটে বেড়ানোর দৃশ্যগুলি হরিদাকে যেন এক ভিন্ন চেহারায় আমাদের কাছে উপস্থিত করে।

প্রসন্নতা: শত দারিদ্র্যের মধ্যেও হরিদা চরিত্রের সদাপ্রসন্ন মূর্তিটি উজ্জ্বল হয়ে জেগে থাকে। ভাতের হাঁড়িতে শুধু জল ফুটলেও হরিদার মনে বিকার নেই। নিজের দারিদ্র্যকে তিনি যেন ওই হাঁড়ির ভিতরেই ঢাকনা দিয়ে বন্ধ রাখেন, বাইরে প্রকাশ পেতে দেন না। তার পরিবর্তে মজে ওঠেন আড্ডা আর মজলিশে।

প্রশ্ন: "ওতে যে আমার ঢং নষ্ট হয়" কিসে বক্তার ঢং নষ্ট হয়ে যায়? এই বক্তব্যের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

উত্তর: উদ্ধৃত অংশটি সুবোধ ঘোষের লেখা 'বহুরূপী' গল্প থেকে নেওয়া হয়েছে। উক্তিটির বক্তা হলেন গল্পের প্রধান চরিত্র হরিদা‌।

বহুরূপী হরিদা যেদিন সন্ধ্যায় বিরাগীর সাজে সজ্জিত হয়ে জগদীশবাবুর বাড়িতে গেলেন, সেদিন জগদীশবাবু তাঁর কথাবার্তায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে একশো টাকা প্রণামী দিতে চেয়েছিলেন। দরিদ্র হরিদা সেই টাকা না নিয়ে সত্যিকারের বিরাগীর মতোই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান।

এই ঘটনার মধ্যে এক সুগভীর ব্যঞ্জনা রয়েছে। একদিকে হরিদার জীবন-দর্শনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সত্যিকারের বিরাগী মানুষটির পরিচয় পাওয়া গেছে হরিদার এই কথায়। দ্বিতীয়ত বোঝা গেছে হরিদা একজন সত্যিকারের শিল্পি। তিনি তাঁর বহুরূপীর সজ্জা দিয়ে মানুষকে আনন্দ দিতে চান, মানুষকে ঠকানো তাঁর লক্ষ্য নয়। নিজের ঢং দিয়ে মানুষকে ঠকালে হরিদার পেশার পবিত্রতা নষ্ট হবে, প্রতারণার স্পর্শে তাঁর ঢং কলুষিত হয়ে পড়বে। হরিদা কখনোই তা হতে দিতে পারেন না। বহুরূপী হিসেবে বকশিশের দু চার পয়সার বেশি তিনি কোনোদিন কার‌ও কাছেই নেননি। সামান্য বহুরূপী হয়েও নিজের পেশার প্রতি হরিদার সততা তাঁর চরিত্রকে এক অসামান্য উচ্চতায় আসীন করেছে।

বাংলা ব্যাকরণ শিখতে আমাকে YouTube-এ ফলো করার জন্য এখানে ক্লিক করো।

আর‌ও পড়ো

Comments

Popular Posts